Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ব্যবসা বাণিজ্য

মুক্তাগাছার মন্ডা

গোপাল পালের মন্ডা । ছানার তৈরি অসাধারণ মিষ্টির নাম। এই মন্ডা সুষ্টির আদিগুরু গোপাল পাল। প্রায় দুইশত বছর পূর্বে ১২৩১ বাংলা ১৮২৪ ইংরেজি সনে গোপাল পাল সর্বপ্রথম মন্ডা তৈরি করেন। গোপাল পালের তৈরিকৃত মন্ডা তৎকালিন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরি প্রথম স্বাদ গ্রহণ করেন এবং খুবই প্রশংসা করেন। মুক্তাগাছার মন্ডার জনক গোপাল পালের পুরো নাম হচ্ছে রাম গোপাল পাল। তার জন্ম বাংলা ১২০৬ ও ইংরেজি ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। গোপাল পালের আদি নিবাস মুর্শিদাবাদ। নবাব সিরাজ –উদ-দৌলার পতনের পর রাজধানী মুর্শিদাবাদের জনগন বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। গোপাল পালের পিতা রাম রাম পাল প্রাণভয়ে পালিয়ে মালদহ হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে বসতি স্থাপন করেন। এরপর সেখান থেকে মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে নতুন করে বসবাস শুরু করেন। মন্ডা সৃষ্টির পিছনে কথিত কিছু ইতিহাস আছে। রমেন্দ্র নাথ পাল তার “মন্ডা আলেখ্য “ গ্রন্থে লিখেছেন, “ গোপাল পাল স্বপ্নে প্রায়ই এক সাধুর দেখা পেতেন। স্বপ্নে সাধু তাকে মন্ডা তৈরির নিয়মাবলী শেখাতেন। প্রায় রাতেই সাধু কিছু কিছু মন্ডা তৈরির নিয়ম বলতেন। সর্বশেষ এক রাতে মন্ডা পাকের শেষ নিয়মটি শেখালেন এবং বললেন,” তুই এই মন্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোর মন্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।

বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক আলোচনায় ভারত থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ীতে আসতেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সহ আরো অনেক গুণীজন। জমিদাররা তাদের মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মহারাজা সূর্যকান্ত মন্ডার অন্ধ ভক্ত ছিলেন। তার পুত্র শশীকান্তও মন্ডা খুব ভালোবাসতেন। রাজা শশীকান্তের সাথে বেশ ভালো সর্ম্পক ছিল রাশিয়ার বিখ্যাত নেতা স্ট্যালিনের। স্ট্যালিনকে বাঙলাদেশের শ্রেষ্ঠ মিঠাই মুক্তাগাছার মন্ডা পাঠান তিনি। স্ট্যালিন মন্ডা খেয়ে খুব মুগ্ধ হলেন। মন্ডার আরেকজন ভক্ত ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। পূর্ব বাংলার গভর্ণর মাঝে মাঝে তাকে মন্ডা পাঠাতেন। তিনি  মন্ডাকে বলতেন “পূর্ব পাকিস্তানকা মেওয়া।“

মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তান আমলে মুক্তাগাছার মন্ডার দোকানে অনেকবার মন্ডা খেয়ে গেছেন। মাওলানা ভাসানী চীনা রাজা মাও সেতুং এর আমন্ত্রণে চীন যাবার সময় মুক্তাগাছার মন্ডা নিয়ে গিয়েছিলেন। মাও সেতুং মণ্ডার খুবই সুখ্যাতি করেছিলেন এবং মণ্ডার জন্য বাংলাকে নতুন করে চেনার কথা বলেছিলেন। তঙ্কালীন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ মুক্তাগাছার মন্ডার দোকানে এসে মণ্ডা খেয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহ ও এর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

একবার ময়মনসিংহ মিটিং শেষে মুক্তাগাছার মণ্ডা খেতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব মণ্ডার স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন মালিক কেদার নাথকে বলেছিলেন, পাল মশাই দেশ ছেড়ে যাবে না, দেশের ভালো হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তাকে মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। এরপর বৃটেনের রানী এলিজাবেথ যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তার আপ্যায়নের জন্য নেওয়া হয় মুক্তাগাছার মণ্ডা। বাংলাদেশের আরেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে ঢাকায় এক ইফতার মাহফিলে মুক্তাগাছা থেকে মণ্ডা নিয়ে সবাইকে ইফতার করিয়ে ছিলেন।বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মণ্ডা খুব পছন্দ করতেন। তিনি বেশ কয়েক বার দোকানে এসে মণ্ডা খেয়েছেন।সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন দোকানে মণ্ডা খেতে খেতে বলেছিলেন, “জামালপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ অথবা মুক্তাগাছার উপর দিয়ে গেলে মণ্ডা না খেলে এবং না নিয়ে এলে ঢাকায় ফিরলে অতৃপ্ত মন নিয়ে ফিরতে হয়। মনে হয় শূন্য হাতে ফিরলুম, কী যেন ফেলে রেখে গেলুম। কী যেন নেওয়া হলো না।এ শুধু মুক্তাগাছার মণ্ডার ঘরই না, এ যেন মুক্তাগাছার প্রাচীন ঐতিহ্য।

”পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, জাপান , কোরিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু বিদেশী পর্যটকগন Bangladesh a Lonely Planet Travel Survival Kit, ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় লিখা বইটি হাতে নিয়ে এসে বইটিতে লিখা দোকান ঘরের বর্ণনা মিলিয়ে দেখে ও মন্ডা খেয়ে, "Very Nice" "Delicious Sweet Meats" বলে প্রশংসা করেন। পর্যটকগন দোকানে ঢুকতেই দরজার উপর সিমেন্টের তৈরি সিংহের ছবি ও ভেতরের কাচের সুদর্শন শোকেসে সুরক্ষিত বাংলা ১৩০৯ ও ইংরেজী ১৯০২ সালে তৈরি গোপাল পালের কাঠের প্রতিকৃতিটি দেখে মুগ্ধ হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোপাল পালের বংশধরগণ ভারতে চলে যান। সেখানে মণ্ডা তৈরি করেন। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া বাংলাদেশের মণ্ডার জন্য বিশেষ উপযোগী ছিলনা। তাই আগের স্বাদ আর হয়নি। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের পর পুনরায় ফিরে এসে সেই একই স্থানে মণ্ডা তৈরি আরম্ভ করেন। যুদ্ধের সময় মণ্ডার অনেক উচ্চ প্রশংসাপত্র হারিয়ে গিয়েছে।মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ "আমি" বইয়ে লিখেছেন যে মণ্ডা হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের মিষ্টান্ন যা দুধ চিনির দ্বারা বিশেষ কৌশলে তৈরি করা হয়। তিনি ১৯৫৩ সালে নিজস্ব প্যাডে গোপাল পালের মণ্ডার প্রশংসাপত্র পাঠান যা আজও দোকানের দেয়ালে বাঁধানো আছে।

মণ্ডা শুধু মুক্তাগাছার নয়, এ হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের ঐতিহ্য।